মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বর্ণক্ষত। সাহসী যোদ্ধারা স্বাধীন দেশের স্বপ্নে ঘাতকবুলেট নিয়েছিল বুক পেতে। সেই বুলেটের ক্ষতচিহ্নকে যুদ্ধজয়ের সাহস করে এগিয়েছিলেন তাঁরা। সেই ক্ষতের সোনালি রক্ত—পঁুজ আর সম্ভ্রমহানি ও আত্মদান থেকে উঠে এলো স্বাধীন বাংলাদেশ, উঠে এলো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। আর পাকিস্তানের মতো একটি অপরাষ্ট্রের ঘাড়ে কালো তিলক এঁকে দিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। এসব বীরত্ব নিয়ে সংখ্যাহীন গল্প—উপন্যাস—কবিতা, প্রবন্ধ—নিবন্ধ—ইতিহাস রচিত হয়েছে। তারপরও যেন এই স্বর্ণক্ষতের কথা বলা শেষ হয় না। নয় মাসের ওই সময়টি সহস্র বছরের সময়কেই ধারণ করল। ফলে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধই সব কথা নয়। এর আগে পরে অনেক ঘটনাই ওই ইতিহাসের অবিচ্ছিন্ন অংশ। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অসংখ্য রচনা তৈরি হলেও সেগুলোর মধ্যে খুব কমই ওই অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস উঠে এসেছে। আমি এই গ্রন্থভুক্ত গল্পে সেই অব্যাখ্যাত সময়কেই সেলাই করেছি। সেই সাতচল্লিশ থেকে চলমানকালের নৌকায় আমি গল্পের পাল তুলে দিয়েছি। বাংলাদেশের রাজনীতি—অর্থনীতি—সমাজনীতি, মানবিকতা—মৌলবাদিতা বিধৌত অগ্রপশ্চাদের কেন্দ্রেই স্থাপিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। দেখা যায় নয় মাস সময়ের চেয়ে এর আগে—পরের সময়গুলো কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতি তৈরিতে সেই সময়গুলোর ভূমিকাই সূচিত করেছে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের স্বাধীন ভূখণ্ড। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর বীরত্ব একই নদীরই স্রোত। একাত্তরে রক্ত মিশে গৌরব ও ঔজ্জ্বল্যে পরের সময়গুলোও হয়ে আছে অতীত ে¯্রাতেরই নিয়মিত প্রবাহ। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলো না। রাজনীতি—শ্রেণি বিরোধিতা, মৌলবাদ, যুদ্ধাপরাধী ও কূপমণ্ডূকতা, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক—সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এমন অনেক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি থাকল। এসব পরিস্থিতি বা সময়কে আমি ওই মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসেবেই গণ্য করেছি। আমি মনে করি এই হিসেবের খাতা শেষ হবে না। যে চেতনায় এবং যে দাবিতে বাংলার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার দৃশ্যমান বাস্তবায়ন যতদিন না হবে, ততদিন আমার গল্পের চরিত্ররা হিসাব কষেই যাবে। আমি গল্পের কোনো চরিত্রকেই কোথাও থামাতে চাই না। তারা চলমান। গল্পের বর্ণনা এক সময় শেষ হলেও দৃশ্য কিন্তু তার যাত্রা থামায়নি। আমি না পারলেও সে কথা উঠে আসবে নতুন কোনো কবি—সাহিত্যিকের কলমে। সময়ই কাউকে না কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিটি সময়ে জন্ম নেয় মহা বিপ্লবী। নতুন কোনো বিপ্লব, নতুন কোনো বক্তা পরিচয় করিয়ে দেবে তার সাথে। আমি এই গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর মধ্যেই রেখে গেলাম তার আভাস।
About This Books